হেলেঞ্চা শাকের পুষ্টিগুন ও উপকারিতা
সূচিপত্রঃ হেলেঞ্চা শাকের পুষ্টিগুন ও উপকারিতা
হেলেঞ্চা শাকের পুষ্টিগুণ
এই শাকের বর্ণনা
এই শাকের বর্ণনা পড়লে বোঝা যায় এটি ভারতের পূর্বাঞ্চলা ও বাংলাদেশের ডোবা পুকুর বা ভেজা জায়গায় অগভীর জলাশয়ের ধারে এই শাক হয়ে থাকে।এই গাছগুলি অল্প পানিতে ভেসে থাকে।এই শাকে আবার ফুলও হয়।এর ফুলের রং সাদা।আকারে ছোট ছোট।কান্ডের শীর্ষে গুচ্ছ হয়ে এর ফুল ফোটে।বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় এই শাক এমনি এমনিই হয়ে থাকে।তাই বাংলাদেশে এটি অনাবাদি শাক হিসেবেই পরিচিত।
এই গাছের পাতা শাক হিসেবে খাওয়া হয়ে থাকে।বাংলাদেশে এটি হিংচা বা হেলেঞ্চা শাক হিসেবে পরিচিত।হেলেঞ্চা গাছ লম্বায় ৩০ থেকে ৩৬ সেন্টমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়।এর পাতার দৈর্ঘ্য ২ থেকে ৭ সেন্টমিটার পর্যন্ত হয়।এই শাকের ইংরাজি নাম Buffalo Spinach.এটি একটি সপুষ্পক উদ্ভিদ।হেলেঞ্চা শাক তিতির শাক,তিতির ডাটা,তিতা ডগা,হিমলোচিকা,হেলচী,হিংচা ইত্যাদি নামে পরিচিত।
হেলেঞ্চা শাক এর ঔষধি গুণ
হেলেঞ্চা শাকের উপকারিতা
- ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা প্রতিরোধঃশীতকালে গায়ে কাটা ও গরমে ঘামাচি এই দুইটি আমাদের জন্য খুবই কষ্টদায়ক হয়ে দাঁড়ায়।প্রতিদিন সকালে এই শাকের রস তিন চার চামচ করে খেলে উপকার পাওয়া যাবে।এছাড়াও এর পাতা সামান্য পানি দিয়ে বেটে সারা শরীরে মাখলে উপকার পাওয়া যায়।
- যকৃৎ দূর্বল হলেঃযকৃৎ দূর্বল হলে নানা ধরণের রোগ দেখা যায়।১০০ গ্রমা শকে ১৫০মিলিলিটার পানি মিশিয়ে পরিমাণমত লবণ মিশিয়ে সেদ্ধ করতে হবে।পানি ফুটে এক কাপ পরিমাণ হলে পাত্রটি চুলা থেকে নামিয়ে নিতে হবে।ঠান্ডা হলে খাবার খাওয়ার আগে সামান্য পরিমাণে সরিষার তেল মিশিয়ে খেতে হবে।অবস্থা বুঝে ২ থেকে ৪ সপ্তাহ পর্যন্ত এটি খেতে হবে।তাহলে যকৃৎ ভাল থাকবে।
- কোমরের ব্যথা ভাল হয়ঃকোমরের নিচে ব্যথা বা যন্ত্রনা,পায়েরপেশিতে রাতেরবেলা টান ধরলে সকালে খালি পেটে বেশ কিছুদিন হেলেঞ্চা শাকের রস তিন চা চামচ গরম করে খেলে ব্যথা ভাল হয়ে যায়।
- পিত্ত বাড়লেঃপিত্ত বাড়লে হেলেঞ্চার পাতা বেট ৩০ মিলিলিটার রসের সাথে ৫০ মিলিমিটার গরু কিংবা ছাগলের দুধের সাথে মিশিয়ে প্রতিদিন খেলে পিত্ত স্বাভাবিক হবে।গনোরিয়া রোগের জন্য একই পরিমাণে খেলে এই রোগ ভাল হয়।
- বসন্ত রোগের সমাধানঃপ্রাথমিক অবস্থায় অর্থাৎ দু একটি গুটি দেখা পাওয়া মাত্রই দেড় থেকে দুই গ্রাম গুঁড়ো দুধের সাথে হেলেঞ্চা শাকের রস আধা কাপ ভালভাবে মিশিয়ে খেলে দ্রুত উপকার পাওয়া যায়।
- রক্ত দূষিত হলেঃরক্ত দূষিত হলে ২০ মিলিলিটার পাতা ও ডাঁটা বাটা রস এক চামচ চিনির সথে মিশিয়ে খেলে দ্রুত রক্ত পরিষ্কার হয়।জিহ্বায় মোটা সাদা প্রলেপ পড়লে খাবারে অরুচি হয়।কিছুদিন হেলেঞ্চার রস গরম করে খেলে ভাল হয়ে যায়।এছাড়াও যারা নিম্ন রক্তচাপে ভুগে থাকেন তারা যদি সকালে ২ চামচ হেলেঞ্চার রস,২ চামচ কলমি শাকের রস,২ চামচ মধু মিশিয়ে রোজ সকালে খেলে নিম্ন রক্তচাপ স্বাভাবিক হবে।
- গর্ভবতী ও পিরিওডের সমস্যায় হেলেঞ্চা শাকঃহেলেঞ্চা শাকে প্রচুর পরিমণে খণিজ আর ভিটামিন যুক্ত।এছাড়াও এতে রয়েছে জিঙ্ক,ফলিক এসিড,সালফার,আয়রন।যা শরীরে রক্তের পরিমাণ বাড়ায়।ফলে গর্ভতী মহিলাদের জন্য এটি খুবই উপকারীএবং যেসব মেয়েদের পিরিয়ডের সমস্যা আছে তাদের এই শাক খাওয়া উচিত।আবার অনেকে গর্ভাবস্থায় এই শাক খেতে বারণ করেন সন্তান জন্মদানে বাধা আসবে মনে করে।ডাক্তাররা তাই গর্ভবতী ও পিরিওডের সমস্যায় ভোগা মেয়েদের এই শাক খেতে বলেন।সন্তান জন্মদানের পরে মায়েদের শরীরে অনেক নারীর লৌহের ঘাটতি দেখা যায়।এই সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে হেলেঞ্চা শাক।তবে যে কোনো কিছু খাবার আগে অবশ্যই নিশিচত হবার জন্য ডাক্তারের পরামর্শ নিয়েই খাওয়া উচিত।
- সর্দি-কাশিতে হেলেঞ্চা ঃসর্দি কাশির সমস্যা দেখা দিলে এই শাকের রস বা সেদ্ধ করে ভাতের সাথে খেলে অনেক উপকার করে।সরররদি কাশি নিরাময়ের এই প্রাকৃতিক মহাঔষধ আমাদের জন্য অনেকটা আর্শীবাদ স্বরূপ।কারণ ঔষধ এর পার্শ্বপ্রতিকক্রয়য়া থাকলেও এই প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া ঔষধি গুণের কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রীয়া নেই।যা আমরা ছোট থেকে বড় সকলেই গ্রহণ করতে পারি।
এই শাকের আবাস ও বৈজ্ঞানিক নাম
গাছের শীর্ষে শীতকালে ছোট সাদা গুচ্ছ ফুল ফোটে।হেলেঞ্চা শাকের বৈজ্ঞানিক নাম Enhydra fluctuans যা Asteraceae পরিবারের অন্তর্ভূক্ত।এর ইংরেজি নাম Helencha,Buffalo spinach,Common Enhydra.
এই শাক কোথায় পাওয়া যায় ও দাম
হেলেঞ্চা শাকের কয়েকটি মাজাদার রেসিপি
হেলেঞ্চা শাকের কয়েকটি মাজাদার রেসিপি আছে। আমরা বাঙালিরা অত্যাধিক ভোজন রসিক।তাই আমাদের শুধু পুষ্টিগুণ হলেই চলে না।আমাদের লাগে স্বাদও।এই শাক শুধুই পুষ্টিগুণে ভরা তা না।এটি স্বাদের দিক থেকেও অতুলনীয়।রান্নাটাও এক ধরণের শিল্প।রান্নার শিল্প আমরা এর স্বাদের এবং পরিবেশনের মাধ্যমে তুলে ধরতে পারি।
তাই তো হেলেঞ্চা শাক এর পুষ্টিগুন এর পাশাপাশি আমি আপনাদের কাছে এর কিছু সাধারণ কিন্তু মুখে রুচি আনার মত অতুলনীয় স্বাদের কয়েকটি মজার রেসিপিও নিয়ে হাজির হলাম।যদিও আমরা সবাই জানি।তবুও দিলাম'আপনাদের কাছে যদি এরকম মজার কিছু রেসিপি থাকে তাহলে আমাকে নিচের দেয়া যোগাযোগে মেসেজ করে বা কমেন্টে জানাতে পারেন।
- চিংড়ি দিয়ে হেলেঞ্চা শাকঃচিংড়ি মাছ এমন একটি মাছ যা কিনা সকল কিছুর সাথে গিয়ে স্বাদ কে অতুলনীয় করে গড়ে তুলে।হেলেঞ্চা শাক কুচি করে কেটে,ধুয়ে যদি বেশি করে সরিষার তেল,পেঁয়াজ,রসুন,শুকনা মরিচ ফোঁড়ন দিয়ে নামানোর আগে ভাজা চিংড়ি মাছ দিয়ে রান্না করা হয় এবং গরম গরম ভাতে কাঁচা সরিষার তেল মাখিয়ে কাঁচা মরিচ দিয়ে খেতে অনেক মজা।
- হেলেঞ্চা বড়াঃহেলেঞ্চা শাকের পাকোড়া অনেক মজাদার একটি খাবার।এই শাক ধুয়ে সুন্দর করে বেশি পরিমাণে বেটে বা কুচি করে সারা রাত এক সাথে ভিজিয়ে রাখা মসুর,খেসাড়ি ও মটর ডালের বেটে নিতে হবে।তাতে লবণ,হলুদ,কাঁচা মচা,আদা,বেশি পরিমাণে পেঁয়াজ ও রসুন কুচি দিয়ে মাখিয়ে ডুবো তেলে মুচ মুচে করে ভেজে নিলেই তৈরী হয়ে যাবে মজাদার বিকালের নাস্তা হিসাবে হেলেঞ্চা পাকোড়া।এছাড়াও এটি গরম ভাত বা খিচুড়ি দিয়েও খেতে মজা হয়।
- মৌরলা মাছ দিয়ে হেলেঞ্চাঃমৌরলা মাছ দিয়ে এই শাক রান্না অনেক মজার হয়।১ আঁটি শাকের সাথে ১০০ গ্রাম মৌরলা মাছ নিতে হবে।লবণ,হলুদ দিয়ে মাখানো পরীষ্কার মাছ কে ভেজে নিতে হবে।তারপর গরম সরিষার তেলে লবণ, পেয়াজ,রসুন,কাঁচা মরিচ ফোড়ন দিয়ে কুচি করা শাক দিয়ে দিতে হবে।তারপর শাক ও শাকের ডাটা নরম হয়ে আসলে শাকের মধ্যে ভাজা মাছ ও সামান্য পানি দিয়ে ঢেকে দিতে হবে।মাখা মাখা হয়ে গেলে তৈরী সাধারণ রেসেপিতে মজাদার হেলেঞ্চা মৌরলা মাছ।
- পুঁটি মাছ দিয়ে হেলেঞ্চাঃহেলেঞ্চা শাক দিয়ে ভাজা পুঁটি মাছ খেতে অনেক মজা।এটি গ্রাম বাংলার একটি সাধারণ খাবার।সাধারণ হলেও এটি অনেক সুস্বাদু।লবণ,হলুদ মাখানো ভাজা পুঁটি মাছ ফোঁড়ন দেয়া শাকে দিয়ে ঝোল রান্না করে খেতে বেশ স্বাদের।মুখের রুচিরও পরিবর্তন হয়।
- সাধারণ হেলেঞ্চা শাক ভাজিঃএছাড়াও এই শাক কুচি করে লবণ হলুদ দিয়ে অল্প পানিতে সেদ্ধ করে নিয়ে তেলে পেয়াজ,রসুম,কাঁচা মরিচ ফোঁড়ন দিয়ে তৈরী করা অতি সাধারণ মুখরোচক শাক বাজি।
- কুমড়ো বড়ি দিয়ে শাকঃকুমড়োর বড়ি রাজশাহী অঞ্চলের বিখ্যাত ও সুস্বাদু একটি খাবার এই বড়ি হেলেঞ্চা শাকের সাথে রান্না করলে অনেক ভাল লাগে।আমরা সাধারণ যেভাবে শাক ভাজি সেই ভাবেই করতে হবে।শুধু বড়ি আলাদা করে তেলে ভেজে একটু আধা ভাঙা করে শাকে হালকা পানি থাকা অবস্থায় দিয়ে দিতে হবে.১০ মিনিট অল্প আচে ভাপে রেখে দিলেই তৈরী বড়ি দিয়ে শাক।
- হেলেঞ্চা শাকের ভর্তাঃঅতি সাধারণ এই শাকের ভর্তা আমাদের শরীরে অনেক পুষ্টিগুণ পৌঁছে দেয়।এটি হালকা তিতা খেতে হলেও শরীরের জন্য উপকারী।অল্প পানিতে এই শাক সেদ্ধ করে পাটায় বেটে নিতে হবে।তারপর সরিষার তেল,লবণ,হলুদ,পেঁয়াজ কুচি,কাঁচা মরিচ কুচি দিয়ে মাখিয়ে গরম ভাতে খেতে অনেক স্বাদের।এই খাবার গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষের মুখে হাসি ফোটায়।
- হেলেঞ্চা শাকের পাকোড়াঃহালকা কুসুম গরম পানিতে পরিমাণমত বেসন ও চালের গুড়ি দিয়ে লবণ,হলুদ,মরিচের গুড়া,সামান্য রসুন বাটা দিয়ে ভালভাবে ফেটিয়ে নিতে হবে।তারপর হেলেঞ্চার গোটা শাক গুলি বেসন ও চালের গুড়ির ব্যাটারে ভালভাবে মিশিয়ে নিয়ে ডুবো তেলে ভাজলেই রেডি এই শাকের মুচমুচে পাকোড়া।
রওশন ব্লগের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url